নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠত্ব, ইতিহাস
বর্তমান সময়ে আমরা অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনে থাকি। যেমন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি,হ্যার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি,স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি,ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির মত অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো সবই কয়েকশ বছরের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু আপনি কি জানেন একসময় আমাদের এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন সবথেকে বড় বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে ছিল।
হয়তো আপনি জানেন। আর যদি না জানেন তাহলে জেনে নিন সেটি হচ্ছে “নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়”।
কি? নামটি শুনে পরিচিত মনে হচ্ছে? আমরা অনেকেই আমাদের বইয়ের পাতায় হয়তো পড়েছি।
আজকে আমরা সেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব গাঁথা ইতিহাস সম্পর্কে জানব।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান:-
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান বিহার, ভারতের শ্যামল সমভূমিতে অবস্থিত। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি আর নেই শুধু রয়েছে এর ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু এর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে একটি গৌরবময় অতীতের চিহ্ন প্রতিফলিত হচ্ছে ।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দীর কাছাকাছি প্রতিষ্ঠিত হয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিনিময়ের একটি অতুলনীয় কেন্দ্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। এর শিক্ষাব্যবস্থা অনেক বেশি উন্নত ছিল এবং আধুনিক ছিল। যার সুনাম দূর থেকে দূরে পৌঁছে গিয়েছিল। যা দূরবর্তী দেশ থেকে পণ্ডিত এবং ছাত্রদের আকৃষ্ট করেছিল । এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দূর দেশ থেকে পন্ডিত ও ছাত্ররা আসতেন। এই প্রবন্ধে, আমরা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের রহস্য, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্ববিদ্যালয় কে প্রতিষ্ঠা করেন, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠত্ব, এবং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সম্পর্কে জানতে পারবো। সুতরাং সম্পূর্ণ পোস্ট মনোযোগ দিয়ে পড়ার অনুরোধ রইল।
আরো পড়ুন:আপনার জিমেইলের জায়গা খালি করুন এক ক্লিকে।
প্রতিষ্ঠা ও প্রাথমিক ইতিহাস:
গুপ্ত রাজবংশের বিশেষ করে সম্রাট কুমারগুপ্ত প্রথমের দৃষ্টি ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্য নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কখনো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। প্রাথমিকভাবে একটি বৌদ্ধ বিহার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ধীরে ধীরে বৌদ্ধ অধ্যয়ন এবং একাডেমিক পাঠের জন্য একটি বিখ্যাত কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে অনেক ঐতিহাসিকদের মতবাদ রয়েছে। তাই এর সঠিক তারিখ জানা কষ্টসাধ্য। তবে প্রায় ঐতিহাসিকগণ মনে করেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পঞ্চম/৫ম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
আরো পড়ুন:-জেনে নিন কালোজিরার উপকারিতা
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কারিকুলাম:-
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল বা সম্মান অর্জন করতে পেরেছিল এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে। এর মধ্যে একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মান এবং ব্যাপক পাঠ্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়টি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যে সাবজেক্ট গুলো পড়ানো হতো বা যে সাবজেক্টে পাঠদান করা হতো এগুলোর মধ্যে ছিল বৌদ্ধ দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, সংস্কৃত সাহিত্য, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং আরও অনেক কিছুর মতো বিষয়গুলি কভার করে বিস্তৃত পাঠক্রম পড়ানো হতো। পাঠ্যক্রমটি সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, বিতর্ক, জ্যোতির্বিদ্যা অর্জন, চিকিৎসা শাস্ত্র, সাহিত্যে জ্ঞান অর্জন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের উপর জোর দেয়া হতো। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আচার্য নামে পরিচিত সম্মানিত পণ্ডিতদের নির্দেশনায় কঠোর বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তৃতা ও গবেষণা করতো । নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপক পাঠদান এবং উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সম্মানের মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনা করতে আসতো।
আরো পড়ুন:-মোবাইল, কম্পিউটার দিয়ে অনলাইন থেকে আয় করার সহজ উপায়
সুবর্ণ যুগ এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব:-
সোনালী যুগে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রাণবন্ত বৌদ্ধিক কেন্দ্র হিসাবে বিকাশ লাভ করেছিল যা সমগ্র এশিয়া এবং তার বাইরের পণ্ডিত এবং ছাত্রদের আকর্ষণ করেছিল। একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি এবং এর বিস্তৃত লাইব্রেরি, হাজার হাজার পাণ্ডুলিপি এবং পাঠ্যের আবাসন, এটিকে বৌদ্ধ অধ্যয়নের জন্য একটি বিখ্যাত কেন্দ্র এবং প্রাচীন বিশ্বের জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হিসাবে পরিণত করেছে। চীন, কোরিয়া, জাপান, তিব্বত, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলের পণ্ডিতরা এবং ভ্রমণকারীরা নালন্দায় অধ্যয়ন করতে এবং ধারণা বিনিময় করতে আসেন, যা এর মহাজাগতিক পরিবেশ এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবে অবদান রাখে।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতন:-
এর বর্ণাঢ্য ইতিহাস সত্ত্বেও, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক শতাব্দী ধরে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পেছনে যে কারণ গুলো রয়েছে তার মত কিছু কারণ হলো
১)ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতন,
২)বিদেশী শক্তির আক্রমণ
৩)অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা
১/বৌদ্ধ ধর্মের পতন:-বৌদ্ধ ধর্মের পতন একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনের। বৌদ্ধ ধর্মের অবনমন এবং বিপ্লবী গণের প্রতিরোধের ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে প্রবল প্রতিবন্ধী প্রভাব পড়ে।
২/বিদেশি শক্তির আক্রমণ:-বিভিন্ন সময় হতে ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীর আক্রমণের জন্য নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয় আতঙ্কিত হয়েছিল।
৩/অর্থনৈতিক অবস্থা:- নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনে অর্থনৈতিক অবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে। অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে, বিশ্ববিদ্যালয় উন্নতির কাজে অক্ষম হতে হয়ে পরেছিল। যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি করা সম্ভব হয়নি।
৪)আধুনিকীকরণ:- কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক, ধার্মিক, বা আর্থিক পরিবর্তনের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিকীকরণ ও প্রসারণ সম্ভব হয়নি যা শিক্ষার কার্যক্রমের উন্নতি ও সম্প্রসারণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এছাড়াও আরো অনেক কারণ ছিল যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ধীরে ধীরে পতনের দিকে চলে যায়।
১২শতকে, নদীয়া জেলা এখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির অধীনে হানাদার তুর্কি সেনাদের দ্বারা বরখাস্ত ও ধ্বংস হয়ে গেলে নালন্দা একটি বিধ্বংসী আঘাতের শিকার হয়। ওই সময় থেকে মুসলিম শাসকদের আবির্ভাবের পর বুদ্ধ ধর্ম ভিত্তিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তার খ্যাতি, জৌলস হারাতে শুরু করে। এবং বাইরের দেশ থেকেও পন্ডিত ও শিক্ষার্থীরা আসা বন্ধ করে দেয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় টি ধ্বংস হওয়ার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মভিত্তিক বিশাল সংস্কৃতির পতন ঘটে।বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংস অতুলনীয় বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি যুগের সমাপ্তি চিহ্নিত করেছে।
পুনরায় প্রতিষ্ঠা:-
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হয়ে কয়েক শতাব্দী ধরে ধ্বংসস্তূপে পড়েছিল, তবে এর উত্তরাধিকার পণ্ডিত এবং ভ্রমণকারীদের লেখার মাধ্যমে আবারো পুনরায় চালু হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। আধুনিক যুগে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল ২০১০ সালে। ভারত সরকার নালন্দাকে শিক্ষা ও গবেষণার একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রতিষ্ঠা করে। নতুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টির কাছাকাছি অবস্থিত।
এর লক্ষ্য হল একাডেমিক উৎকর্ষ, বৈচিত্র্য এবং বৌদ্ধিক বিনিময়ের মূল্যবোধ বজায় রাখা যা এর প্রাচীন পূর্বসূরিকে সংজ্ঞায়িত করেছে।
আরো পড়ুন:-বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিশাল চাকরির বিজ্ঞপ্তি।
উপসংহার:
নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এটি অন্ধকারে ঘেরা একটি বৃহত্তর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ব্যবসায়, গণিত, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হত।
নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গুরুগণ ছিলেন আর্যভট্ট, আশ্বঘোষ, ধর্মাকর, ধর্মপাল, নাগার্জুন, আদি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের/পণ্ডিতদের নিয়ে বিশেষভাবে গর্ব করা হতো। যারা অত্যন্ত গুণী এবং জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন।
নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যালয়ী কার্যক্রম প্রশস্ত । এটি ধারাবাহিক সাহিত্য এবং শিক্ষার কেন্দ্র ছিল, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীরা একত্রে আসতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতেন।
তবে, নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনের মূল কারণ বিভিন্ন পরিস্থিতি ছিল, যেমন বৌদ্ধ ধর্মের পতন, বাহ্যিক আক্রমণ, অর্থনৈতিক অবস্থা, আধুনিকীকরণ ইত্যাদি। এই কারণগুলি সমন্ধে বিস্তারিত অধ্যয়নের মাধ্যমে নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের সমৃদ্ধ বৌদ্ধিক ঐতিহ্য এবং শিক্ষা ও বৃত্তির প্রতি তার স্থায়ী প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসাবশেষ হয়ে। বহু শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও, নালন্দার উত্তরাধিকার বিশ্বব্যাপী পণ্ডিত এবং ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার নিরবচ্ছিন্ন সাধনাকে আবারও নিশ্চিত করে। আমরা যখন নালন্দার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণা করি তখন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে এই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানটি ইতিহাসের গতিপথ গঠনে এবং শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে অনেক বড় অবদান রেখেছিল।
বন্ধুরা আজকের এই প্রবন্ধে আমরা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কিছু তথ্য ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছি। আশা করি কিছু তথ্য এখান থেকে পেয়েছেন।
Tag's:- nalonda university, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস